টিউমার ও ক্যান্সার

লিভারে টিউমার ও ক্যান্সার এবং তার চিকিৎসা
লিভারের বাংলা নাম যকৃৎ, ওজন প্রায় ২ কেজি। পেটের ডান পাশজুড়ে এর অবস্থান। এত বড় ও ভারী একটা অঙ্গ পেটের মধ্যে অবস্থান করছে পাঁচটি দড়ির মতো শক্ত বাঁধন দ্বারা। ফলে আমরা যত দৌড়ঝাঁপ দিই না কেন তাতেও এর অঙ্গ স্থানচ্যুত হয় না। এটি শরীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গ। এ অঙ্গের ৭০ ভাগ রক্ত আসে পাকস্থলী, খাদ্যনালি, মলদ্বার, প্লীহা, প্যানক্রিয়াস, পিত্তনালি ও পিত্তথলি থেকে ভেইন দিয়ে। বাকি ৩০ ভাগ রক্তপ্রবাহ আসে হেপাটিক শিরা দ্বারা। স্বাভাবিক অবস্থায় তাই হেপাটিক শিরা বাধা পড়লে লিভারের কোনো ক্ষতি হয় না। পোর্টাল শিরা লিভারের সিরোসিসে নষ্ট হয়ে অকার্যকর হয়, তখন হেপাটিক শিরা লিভারকে বাঁচিয়ে রাখে। হেপাটিক ভেইন দ্বারা রক্ত লিভার থেকে ভেনাকেভা যায়।

মেটাবলিক ও সিনথেসিস কার্যক্রম পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বহনকারী হলো লিভার। খাদ্যনালির সব গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানসমৃদ্ধ রক্ত খাদ্যনালি থেকে রক্ত দ্বারা প্রবাহিত হয়ে লিভারে আসে। লিভার এটা থেকে শক্তি তৈরি করে যা শরীরকে সতেজ ও শক্তিশালী রাখে। একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন একজন ডায়রিয়ার রোগী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কীভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, রমজান মাসে সারাদিন উপবাস থাকার পর রোজাদার ইফতারের আগ পর্যন্ত কত দুর্বল হয়ে পড়ে। লিভার ম্যাস বা লেশন চিকিৎসককে মারাত্মক ভাবিয়ে তোলে। এর ফলে রোগের লক্ষণ নানাবিধ হয়। এ লেশনের আওতায় পড়ে টিউমার, সিস্ট, অ্যাবসেস, হেমাটোমা, গ্রানুলোমা, লিভারের ক্যান্সার ইত্যাদি। যা নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার অনেক বেশি, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কম। ৩০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সে এ রোগের হার বেশি।

রোগের লক্ষণ
পেটে ব্যথা, ওজন কমে যাওয়া, শরীর দুর্বল হওয়া, ডান পাশের পেটে চাকা অনুভূত হওয়া। পেট ফুলে যাওয়া, পেটে পানি জমা, জন্ডিস দেখা দেয়া, ক্ষুধামান্দ্য, খাওয়ায় অরুচি, বমি হওয়া, পাতলা পায়খানা, পায়খানার বেগ থাকা, রক্ত পায়খানা, রক্তবমি প্রভৃতি দেখা দেয়।

পরীক্ষা পদ্ধতি
১. সাধারণত আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা দ্বারা এ রোগ ধরা যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে আলট্রাসনোগ্রাফিও ব্যর্থ হয়ে যায়।

২. সিরামে বিলিরুবিন বাড়ার কথা থাকলেও অনেক সময় দীর্ঘদিন পরে জন্ডিস দেখা দেয়। কারণ হলো টিউমার হওয়ার পরও দেখা গেছে লিভারের ভালো অংশটুকু স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে, তাই জন্ডিস তখনো দেখা দেয়নি। এ জন্যই বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে।

৩. সিটিস্ক্যান রোগ নির্ণয়ের জন্য খুবই উপকারী। তবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান এবং ডাক্তার দরকার।

৪. টিউমার ও ক্যান্সার ধরনের রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উপকারী। বায়োপসি একমাত্র ভরসা সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য।

৫. পিভকা-২ নির্ণয় করা, যা রক্তে বৃদ্ধি হয়। ক্যান্সারের মাত্রা বাড়ে।

৬. এন্ডোস্কোপি করা জরুরি। লিভার ক্যান্সার রোগীদের খাদ্যনালির ও পাকস্থলীর শিরাগুলো ফুলে ওঠে। তাই তা নির্ণয় করা ও ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে।

৭. প্রোকটোস্কপি করে পাইলস আছে কি না দেখে নিতে হবে। কারণ ক্যান্সার রোগীর মলত্যাগের সময় রক্ত গেলে শুধু পাইলস হয়েছে মনে করে চিকিৎসা করলে তা অনেক সময় ভুল হয়ে যায়।

৮. এমআরআইয়ের দ্বারা সিরোসিসের ছোট ছোট ক্যান্সার ধরা সম্ভব হবে।

৯. ল্যাপারোসকপিক পদ্ধতি, যা দ্বারা ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়।

১০. বুকের এক্স-রে দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে থাকলে তা নির্ণয় করা হয়।

১১. কালার ডপলার দ্বারা লিভার ক্যান্সার রোগীদের সঙ্গে ডায়াবেটিসের নিখুঁত সম্পর্ক আছে। যেমন এক লোকের রক্তে সুগার ধরা পড়ল। সে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকল, কিন্তু সুগার কখনো নিয়ন্ত্রণে থাকে, কখনো থাকে না। এ বিষয়ে সে পেরেশান। কারণ লিভারে ক্যান্সার থাকলেও তা কখনো কোনো লক্ষণ সৃষ্টি করে না। এর ফলে এ রোগ সম্পর্কে সে কিছুই বুঝত না এর আগে। তবে যখন পেটের ডানপাশে বড় একটা চাকা আবিষকৃত হলো তখন তো ভয়াবহ পরিস্থিতি। নানা পরীক্ষার পর আবিষকার হলো এটি লিভার ক্যান্সার, যা আজ জীবনহানি করে দিতে পারে।


নানা অসুখের উপসর্গ, যা লিভার ক্যান্সারের সঙ্গে সংযুক্ত। যেমন- ডায়রিয়া, থাইরয়েড, ওভার ফাংশন, রক্তকণিকার বৃদ্ধি, হাইপারটেনশন, ক্যালসিয়াম বৃদ্ধি, যৌনক্ষমতা লোপ, হাড়ের ব্যথা, নার্ভের অসুখ, লিভার ক্যান্সারের সিরামে কোলেস্টেরল ১১ থেকে ৩৮ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

আলফা কিটো প্রোটিনের বৃদ্ধি ঘটে লিভার ক্যান্সারে। এর মাত্র ৫০০ মাইক্রোগ্রাম/লি এ মাত্রা ৫০০-এর কম হলে মনে করতে হবে ক্যান্সার নয়, অন্য রোগ। যেমন- একিউট ও ক্রনিক হেপাটাইটিস। অন্যান্য ক্যান্সারেও এর মাত্রা বেশি হয় যেমন- অণ্ডকোষ ও ওভারির ক্যান্সার।



কারণ
১. হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ২. হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ৩. সিরোসিস ৪. আলফাটক্সিন ৫. জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ৬. ধূমপান ৭. অতিরিক্ত আয়রন সেবন ইত্যাদি।


চিকিৎসা
যদি একটি লোবে ক্যান্সার থাকে তবে সার্জারি করলে ভালো ফল দেয়।
লিভারের ৮টি সেগমেন্ট আছে। যদি একসঙ্গে ৪টি ফেলে দেয়া যায় তাতেও ফল ভালো পাওয়া যায়। অপারেশন চলাকালে আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা দ্বারা বিশ্বে সার্জনরা ক্যান্সার নির্ণয় করে সার্জারির মাধ্যমে তা নির্মূল করে থাকেন। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট এখন আধুনিক বিশ্বে প্রায় হচ্ছে। ছোট টিউমারগুলো ইথানল ইনজেকশ দিয়ে ধ্বংস করা যায়। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি টিউমার অ্যাবলেশন (আরএফটিএ) ভালো ফল দেয়। কেমোথেরাপিও ভালো ফল দেয় তবে তা প্রথম অবস্থায়।

টিউমারের লক্ষণ দেখা দিলে তখন আর চিকিৎসার উপযোগী থাকে না। তাই শুরুতেই রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। বাংলাদেশে এ বিভাগ শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। লিভার ক্যান্সার হতে পারে-এমন ব্যক্তিকে আলাদা করে তালিকাভুক্ত করা হয়। পরে নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যাতে তাদের রোগ শুরু হওয়া মাত্রই ধরা পড়ে এবং সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়।